সংকটেও রপ্তানি আয় বেড়েছে

0
215

২০২২ সাল কেটেছে সংকটের মধ্য দিয়ে। বছরের দ্বিতীয় মাসেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। তার জেরে দেশে দেশে বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতির চাপ। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। কমতে থাকে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের ক্রয়াদেশ (অর্ডার)। বছরের মাঝামাঝি সময়ে দেশে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট প্রকট হয়। লোডশেডিংয়ের কারণে দিনের বড় একটি সময় কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হয়। এমনও হয়েছে, কোনো কোনো কারখানায় গ্যাসের অভাবে দিনে ১২ ঘণ্টা উৎপাদন বন্ধ ছিল। এমন সংকটের মধ্যে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস, অর্থাৎ গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি আয় সাড়ে ১০ শতাংশ বেড়েছে। সদ্য সমাপ্ত মাস ডিসেম্বরে রপ্তানি আয় হয়েছে ৫৩৭ কোটি ডলার, যা এক মাসের রপ্তানি আয়ের হিসাবে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
ছয় মাসে সাড়ে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির বড় কারণ উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি ও সে কারণে চূড়ান্ত পণ্যেরও দাম বেড়ে যাওয়া। রপ্তানি পণ্যের স্থানীয় মূল্য সংযোজনের প্রবৃদ্ধি ততটা হয়নি। রপ্তানির মতো প্রবাসী আয়ও (রেমিট্যান্স) বাড়ছে। ডিসেম্বরে ১৭০ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে, যা আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ বেশি।
রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের এই ইতিবাচক ধারা দেশের অর্থনীতির জন্য স্বস্তিজনক। কারণ, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে। এখন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ৩ হাজার ৪০০ কোটি (৩৪ বিলিয়ন) মার্কিন ডলারের মতো, যা ২০২১ সালে ৪ হাজার ৮০০ কোটি (৪৮ বিলিয়ন) ডলার পর্যন্ত উঠেছিল। সংকটের কারণে গত মে মাস থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৬ টাকা থেকে ১০৫ টাকায় ওঠে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় নিত্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল ও অন্যান্য পণ্যের দাম। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দুটি উৎস রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে এ দুটি খাত থেকে আয় কমে গিয়েছিল। তবে নভেম্বর থেকে খাত দুটি আবার ঘুরে দাঁড়ায়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সম্প্রতি সোমবার পণ্য রপ্তানির হালনাগাদ পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) ২ হাজার ৭৩১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এটা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি। ছয় মাসে পণ্য রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশ তৈরি পোশাক খাত থেকে এসেছে। এ সময়ে পোশাক রপ্তানি সাড়ে ১৫ শতাংশ বেড়েছে। তবে হোম টেক্সটাইল, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য এবং পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি কমে গেছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে এই তিন খাতের প্রতিটিতে রপ্তানি আয় ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
ডিসেম্বরে তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১৫ শতাংশের বেশি। এই মাসে রপ্তানি হয়েছে ৪৬৬ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে ২ হাজার ২৯৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি।
জানতে চাইলে নিট পোশাক খাতের কারখানা মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক জানান, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে পোশাক বিক্রি কমে গিয়েছিল। এ দুটি আমাদের পোশাকের মূল বাজার। সে জন্য মাঝে দু-তিন মাস ক্রয়াদেশ কমেছিল। তবে ক্রয়াদেশ আসা কিছুটা বেড়েছে। বিদেশি ক্রেতাদের কাছে শুনছি, ক্রিসমাসের বিক্রি ভালো হয়েছে। শীতের বিক্রিও মন্দ নয়। ফলে আগামী শীতের ক্রয়াদেশ ভালো আসবে বলে আশা করছি। এখন বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হলেও গ্যাসের সংকট আছে বলে উল্লেখ করেন ফজলুল হক। আগামী গ্রীষ্মে গ্যাস-বিদ্যুৎ পরিস্থিতি কেমন থাকবে, সেটি নিয়েও উদ্যোক্তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা রয়েছে। কারণ, ক্রয়াদেশ এলেও গ্যাস-বিদ্যুতের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হলে রপ্তানি কমে যাবে।
বিগত ছয় মাসে ৬৪ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ শতাংশ বেশি। এ ছাড়া ৬০ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল, ৫০ কোটি ডলারের কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য এবং ৪৮ কোটি ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি সাড়ে ১৭ শতাংশ, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যে ২৩ শতাংশ এবং হোম টেক্সটাইলের রপ্তানি ১৬ শতাংশ কমেছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ছয় মাসে সাড়ে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির বড় কারণ উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি ও সে কারণে চূড়ান্ত পণ্যেরও দাম বেড়ে যাওয়া। রপ্তানি পণ্যের স্থানীয় মূল্য সংযোজনের প্রবৃদ্ধি ততটা হয়নি। তিনি বলেন, মাঝে দু-তিন মাস ক্রয়াদেশ কম এসেছে। রপ্তানিতে সেটির প্রভাব ফেব্রুয়ারি-মার্চে পড়বে। বাংলাদেশের প্রধান বাজারগুলোতে মন্দার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। তাই গ্রীষ্মের সময় রপ্তানি খাত যেন গ্যাস-বিদ্যুৎ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।